৫০ হাজারের বেশি অবৈধ বিদেশির মধ্যে প্রায় অর্ধেক ভারত থেকে এসেছে

 আইনি দুর্বলতা এবং বিদেশি নাগরিকদের জন্য একটি সমন্বিত তথ্যভাণ্ডার না থাকার কারণে অবৈধ বিদেশিরা বাংলাদেশে নির্বিঘ্নে বসবাসের সুযোগ পাচ্ছে।তবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে বর্তমানে দেশে কতজন বিদেশি নাগরিক বৈধ ও অবৈধভাবে অবস্থান করছেন, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য নেই।  পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও সুরক্ষা সেবা বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে বৈধ বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ১ লাখ ৭ হাজার ১৬৭ জন।

৫০ হাজারের বেশি অবৈধ বিদেশির মধ্যে প্রায় অর্ধেক ভারত থেকে এসেছে


ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ৫০ হাজারেরও বেশি বিদেশি অবৈধভাবে বসবাস করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে, যার মধ্যে অর্ধেক ভারতীয় নাগরিক। যদিও বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী বৈধ ও অবৈধ বিদেশির সংখ্যা কয়েক লাখ হতে পারে।অন্তর্বর্তী সরকার অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ দ্রুত বৈধতা অর্জনের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে।


মো. খোদা বখস চৌধুরী, যিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, জানিয়েছেন যে অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বৈধ নাগরিকদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা ৩৭ হাজার ৪৬৪ জন, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বাধিক।  ভারতের পর চীনের অবস্থান রয়েছে, যেখানে চীনা নাগরিকের সংখ্যা ১১ হাজার ৪০৪ জন।


১৬৯টি দেশের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন, যাদের পাসপোর্ট ও ভিসার মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।এর মধ্যে ভারতের নাগরিক সংখ্যা প্রায় ২৪ হাজার এবং চীনের নাগরিক সংখ্যা ৮ হাজার। পাকিস্তানের নাগরিক সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এছাড়াও, উন্নত দেশগুলো যেমন কানাডা, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, রাশিয়া ও থাইল্যান্ডের নাগরিকরাও বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।


এই অবৈধ বিদেশিদের মধ্যে অনেকেই মাদক ব্যবসা, উপহারের নামে প্রতারণা,  হেরোইন, ব্যাংকের এটিএম বুথে জালিয়াতি, বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রার কারবার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসাসোনা চোরাচালান, অনলাইনে ক্যাসিনো এবং মানব পাচারসহ সংঘবদ্ধ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।আবার কিছু বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে এবং কর ফাঁকি দিয়ে উপার্জিত অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে নিজ দেশে পাচার করছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।



সুরক্ষা সেবা বিভাগের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশের পোশাক ও টেক্সটাইল খাতে বিদেশি কর্মীদের সংখ্যা সর্বাধিক।  এছাড়া, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা, হোটেল ও রেস্তোরাঁয়ও বিদেশি কর্মীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। কাজের অনুমতি না থাকলেও বিজনেস ভিসায় এসে অনেকেই বেআইনিভাবে দেশের বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি গ্রহণ করেন।কাজের অনুমতি না থাকলেও বিজনেস ভিসায় এসে অনেকেই বেআইনিভাবে দেশের বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি গ্রহণ করেন।


তারা বিভিন্ন প্রকল্প এবং চীনা নাগরিকদের বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। এছাড়া, ভারত থেকে আসা অনেকেই ভ্রমণ ভিসায় এসে এখানে বিভিন্ন কাজ বা চাকরিতে যুক্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।  কিছু লোক অবৈধভাবে বাংলাদেশে কাজ করে অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের ভিসা নীতিমালা অনুযায়ী ইউরোপের সব দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, মিসর, ব্রুনেই ও তুরস্ক ছাড়াও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৩টি দেশের নাগরিকরা অন অ্যারাইভাল ভিসা পেয়ে থাকেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, এই অন অ্যারাইভাল ভিসা পাওয়া অধিকাংশ দেশের নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন।


বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের সংখ্যা ১২১৫ জন, যারা অবৈধভাবে এখানে অবস্থান করছেন। সুরক্ষা সেবা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিদেশিদের গ্রেফতার ও তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।  তাদের আটক করার জন্য কোনো ডিটেনশন সেন্টার নেই, এবং যদি তাদের কারাগারে রাখতে হয়, তাহলে মামলা দায়ের করতে হয়।  এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেক সময় এটি এড়িয়ে যাওয়া হয়। এছাড়া, আটক হওয়া বিদেশি নাগরিকদের অধিকাংশের কাছে পাসপোর্ট নেই।


অনেক সময় বিদেশি নাগরিকরা তাদের পাসপোর্ট গোপন রাখেন বা ফেলে দেন।এই অবস্থায় তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা জরুরি, যা সময়ের প্রয়োজন হয়। কিছু দেশের দূতাবাস ঢাকায় না থাকায়, সেখান থেকে আসা ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব যাচাই করা আরও জটিল হয়ে পড়ে।  অন্যদিকে, অবৈধভাবে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করলে তারা মামলার অজুহাত দেখিয়ে এ দেশে থেকে যেতে পারেন।


অভিবাসন খাতের সংশ্লিষ্টরা জানান যে, অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিরা যদি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তবে, যেসব সেক্টরে এসব অবৈধ বিদেশিরা কাজ করছে, সেখানে যদি আমাদের দক্ষ জনশক্তির অভাব থাকে, তাহলে আমাদের দক্ষ জনবল তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তাছাড়া, বৈধভাবে কাজ করা বিদেশিদের ভিসার সঠিকতা নিশ্চিত করাও অপরিহার্য।


এ ধরনের ব্যবস্থা না নিলে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তারা উল্লেখ করেন যে, রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারত থেকে প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে বসবাসরত ভারতীয়দের সংখ্যা এবং তাদের কর প্রদানের সঠিকতা পর্যালোচনা করা উচিত।একইভাবে, অন্যান্য দেশের অবৈধ নাগরিকদের ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।


সুরক্ষা সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব জানিয়েছেন, অবৈধ বিদেশিদের শনাক্ত করে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।  এ ছাড়া, অবৈধ বিদেশিদের অপরাধের প্রকৃতি ও মাত্রার ভিত্তিতে তাদের স্টপ লিস্ট ও ব্ল্যাক লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।আইন ও বিধি অনুযায়ী অবৈধদের শনাক্ত করে জরিমানা আদায় এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। যারা অবৈধভাবে বিভিন্ন কাজ ও ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন, তাদের উপার্জনকে লক্ষ্য করা হচ্ছে।


করের আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।

 এ বিষয়ে রোববার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী মন্তব্য করেছেন যে, কোনো বিদেশি নাগরিককে অবৈধভাবে বাংলাদেশে থাকার অনুমতি দেওয়া হবে না। তিনি জানান, অনেক দেশের নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন, তবে তিনি কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেননি। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে কত বিদেশি নাগরিক রয়েছে, সে বিষয়ে তার কাছে কোনো তথ্য নেই।



অবৈধ বিদেশিদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সময়সীমা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, তালিকা পাওয়ার পর কত দিনের মধ্যে তাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে তা নির্ধারণ করা যাবে। এর আগে, গতকাল সকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, বিভিন্ন সূত্র থেকে অভিযোগ আসছে যে, অনেক বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে কাজ করছেন।


যেসব বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন বা কাজ করছেন, তাদেরকে অবিলম্বে বৈধতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। অন্যথায়, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর আগে, ২৮ মে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল যে, দেশে অবস্থানরত বৈধ ও অবৈধ বিদেশি কর্মীদের সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে।পাশাপাশি, বিদেশি কর্মীরা কিভাবে এবং কোন মাধ্যমে তাদের অর্থ বিদেশে পাঠাচ্ছেন, সে বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।


Share this post with your friends and family

See previous post See next post